মেঘলা রোদ_Written By abhrashilpi
মেঘলা রোদ
Written By abhrashilpi
(#০১)
আজ শ্রাবণ মাসের ১১ তারিখ, ইংরাজির কত তা মনে রাখার দরকার পরে না ধৃতির। রূপমের ঠাকুমাও তো বাংলা তারিখ মেনেই ওর জন্মদিন পালন করতেন। তাই ধৃতিও তাই করে। বেশী কিছু না, একটু পায়েস, যেটা ওর রূপম খেতে সবথেকে বেশি ভালবাসে। যেদিন ও প্রথম রূপমের বাড়ীর রান্নাঘরে পা রেখেছিল, সেদিন ওর জন্য পায়েসই রান্না করেছিল। আর তা ছাড়া আজকের দিনেই তো ওর সঙ্গে প্রথম দেখা ওর রূপের।
সেদিন রবীন্দ্রসদনে ওদের নাচের অনুষ্ঠান ছিল। শাপমোচন নৃত্যানুষ্ঠান। মা বলেই দিয়েছে এই শেষ, এর পরে ধৃতি যেন ওর পড়াশোনাতেই মনোনিবেশ করে, নাচের সিক্সথ ইয়ার সম্পূর্ণ করেছে এটাই অনেক। এর পরে যদি আরও ইচ্ছা থাকে তো অঙ্ক অনার্স করে তারপর। সেই বছরই ধৃতি কলকাতার এক কলেজে ভর্তি হয়েছে। প্রথম প্রথম অ্যানালিসিস, ডায়নামিক্স, 3D জিওমেট্রী সব মাথার এক ফুট উপর দিয়ে যাচ্ছে। একমাত্র স্ট্রেস কাটানোর জায়গা নাচ, বাসবী নৃত্যমণ্ডলী।
ধৃতির খুব ইচ্ছা ছিল নাচ নিয়ে পড়াশোনা করার কিন্তু অনেক ভেবে ও নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এই দেশে মেয়েদের ক্ষেত্রে যেটা পেশা সেটাই নেশা, এটা সবসময় সম্ভব না। সব চিন্তা করেই ও কলেজে ভর্তি হয়েছিল। সেটা ছিল ওর শেষ অনুষ্ঠান আর সেখানেই দেখা ওদের। বার দুই তিন মঞ্চ থেকে চোখাচুখিও হয়েছিল ওর সঙ্গে। নাচের পরে জানা গেল রূপম ধৃতির বন্ধু মিথিলের কলেজের সহপাঠী। রূপম চুপচাপ তাকিয়েছিল ওর দিকে। মিথিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে ঢুকেছে। ধৃতির আমন্ত্রনে সদনে এসেছিল ওর চার পাঁচ জন সহপাঠীকে নিয়ে। রূপম ঠিক ওর নিজের বন্ধু না, বন্ধুর বন্ধু। রূপমের দৃষ্টি বারবার ধৃতির অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। এই অদ্ভূত দৃষ্টির সামনে নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছিল ধৃতির।কেন তাকিয়ে আছে ছেলেটা এই ভাবে? আলাপ করার সময় কিন্তু ওর হাত টা ধরতেই ধৃতির বুকে যেন ড্রাম বাজতে শুরু করেছিল। গোটা শরীর জুড়ে অজানা এক ভাললাগার স্রোত বয়ে গিয়েছিল। সবার সঙ্গে হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে আলাপ করলেও রূপমের বেলায় ওর চোখের দিকে তাকাতে পারেনি। নীচের ঠোঁট কামড়ে কোনভাবে হ্যালো বলেছিল।
পরের দিন কলেজ স্ট্রীট এ ধৃতির কলেজের সামনের বইয়ের দোকানে ওদের দেখা হয়েছিল। সেবারে মিথিল কে দেখে খুব একটা সন্দেহ হয়নি। কিন্তু একই জিনিস বারবার, সপ্তাহে প্রায় তিন চার বার হতে দেখে ধৃতির মনের কোণে ভয়ের মেঘ আনাগোনা করে। ব্যাপারটা কি? দক্ষিণ কলকাতার প্রান্ত থেকে এভাবে প্রায়দিন মধ্য কলকাতার একটি বিশেষ কলেজের সামনের বিশেষ একটি দোকান থেকে এত বই কেনার কি আছে? তার উপর আবার ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের স্টুডেন্ট। এমনিতেই ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্রদের বিশেষ ভাল চোখে দেখেনা ধৃতি। ওর ধারণা সব ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্ররাই কম বেশি অহংকারী হয়। নাক তোলা লোকজন চূড়ান্ত অপছন্দের তার।
(#০২)
তৃতীয় বচনে যতই লিখিনা কেন,যতক্ষণ না রূপম আর ধৃতি ওদের নিজেদের জবানীতে নিজেদের অনুভূতির কথা বলবে, আমরা জানতে বা বুঝতে পারব না ওদের মনের কথা।
তাই পরবর্তী লেখা ধৃতির নিজের কথায়, নিজের বচনে।
ধৃতির কথা~
ইস,মিথিলের এই বন্ধুটা কি যে শুরু করেছে; আচ্ছা ও কি আমার জন্য আসছে এখানে বারবার? কি হবে? ভীষণ ভয় করছে। কাকে বলি?
সব শুনে কিট্টু বলল, দেখ, লাইন টাইন মারছে কি না? ক্রস কানেকশন মনে হলে বলিস, মালটাকে উল্টো ঝুলিয়ে ক্যালাব।
- নানা, অত না, জাস্ট বল না আমার দিকে এভাবে না তাকাতে, কেমন একটা লাগে জানিস; ভারী অস্বস্তি হয় রে।
- হুম, কিট্টু থাকতে তোর এত চিন্তা কেন?
- থাম; তোর এই বিজ্ঞের মত হাবভাব কাকে দেখানোর জন্য জানিনা নাকি আমি? তবে অত আশা করিস না। রিয়াঙ্কা তোকে বিশেষ পাত্তা দেয় না।
কিট্টু কে চুপ করিয়ে কলেজের গেটের সামনে এলাম। ওমা, আবার সেই রূপম। বইয়ের দোকানের সামনে।
নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম, রিল্যাক্স, রিল্যাক্স, ওই ছেলেটা কোন বাঘ ভাল্লুক নয় যে আমাকে খেয়ে ফেলবে; আমায় শুধু নিজেকে সামলে রাখতে হবে যাতে ও আমার কাছাকাছি না আসতে পারে। এরা সাধারণত খুব বাজে হয় আর মেয়েদের সাথে ওইসব করে তাদের ছেড়ে দেয়। না। কক্ষণ না। আমি ওকে কিছুতেই আমার কাছে আসতে দেব না।
তাই নিজেকে সাবধানে থাকতে হবে। আর কিছু হলে কিট্টু তো আছেই।
আমি ওকে দেখেও না দেখার ভান করে সোজা হাঁটলাম। বেশ খানিকক্ষণ পরে পিছনে তাকিয়ে দেখি নেই।
আঃ, শান্তি। কিন্তু গেল কোথায়? কোথাও ঘাপটি মেরে বসে নেই তো? থাকলেই বা কি? এটা কলকাতা; কত লোকজন। আরও কিছুদূর এগিয়ে এলাম।
“হাই ধৃতি;”, আমি চমকে তাকালাম, বই হাতে আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে ছেলেটা।
সৌজন্যের খাতিরে প্রত্যুত্তর দিতেই হল, হাই।
- তুমি এখানে মানে,এই কলেজে পড়?
মনে মনে ভাবলাম, সব খবর যোগাড় করেই তো রোজ দিন অসুবিধায় ফেলতে আসছ, আবার এত জিজ্ঞাসা করার ধূম কেন??
তবুও মাথা নাড়লাম, হাঁ।
পিছনে ট্রামের ঘন্টার শব্দ,আসছি,আমার ট্রাম এসে গেছে।
- কোথায় যাবে? আমিও ট্রামেই যাব।
আমি বিপদ বুঝে ঝাঁঝিঁয়ে উঠলাম, না না, আমি বাসে যাব। আর কোথায় যাব জেনে কি হবে তোমার? আমাদের একদিনের আলাপ, এটাকে বেশীদিন টানতে চাই না আমি। ওকে?
রূপমের মুখটা বেশ করুণ লাগল।আমি ওকে কষ্ট দিতে চাইনি; তাহলে কি না বুঝেই ওকে কষ্ট দিয়ে ফেললাম? আমার কাউকে দুঃখ দিতে একদম ভাল লাগে না।
তবুও নিজের সিদ্ধান্তে অটুট থেকে বললাম, কি ভাবছ? আমি কিছু বুঝিনা? সেই সদনের অনুষ্ঠান থেকে দেখছি, তুমি কেমন ভাবে যেন আমার দিকে তাকাও। আমি সত্যি ভাবিনি মিথিলের থেকে সব জেনে তুমি আমাকে আমার কলেজের সামনে এসে বিরক্ত করা শুরু করবে। শোন, মিথিল আমার ছোটবেলার বন্ধু, আর তুমি ওর কলেজের বন্ধু, তাই এখনও এখানে হাত পা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছ, নাহলে এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকতে হত না। আর যদি একবারও তোমাকে আমার কলেজের সামনে দেখেছি না…..
আমি কথা শেষ না করে সামনের বাসে উঠে পড়লাম। মিথিলকে ঝাড় দিতে হবে। এইসব কি?
তবে বেশ খারাপ লাগছিল আমার।
বাড়ীতে ফিরে দেখি মা যথারীতি কলেজের খাতা দেখতে ব্যস্ত, আর বাবা একা একাই কফির কাপ হাতে বারান্দায়। আস্তে করে ব্যাগ রেখে পিছন থেকে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম, বাবা, একা একা দিব্যি কফি খাচ্ছ বল। তোমার গানের ঘর বন্ধ কেন? রেওয়াজ করবে না?
বাবা তন্ময় হয়ে অস্তগামী সূর্যের দিকে দেখছিল, পিঠের উপর আমার হাত অনুভব করে, আমাকে সামনে আনল, রেওয়াজ করব মা। তুই নাচের রেওয়াজ করবি না?
আমার মুখের বেদনার ছায়া খুব স্পষ্ট বুঝতে পারল বাবা, “শোন মা, পড়াশুনা তার জায়গায় আর শিল্প, শিল্পচর্চা, শিল্পী এরা অন্য জায়গায়। ঈশ্বর তোকে শিল্পী করেই পাঠিয়েছেন। কোন বেরসিক কি বলল, তার কথায় কান দিয়ে নিজের প্রতিভা কেন নষ্ট করবি? ঈশ্বর যা দিয়েছেন সেটার যত্ন না করে অন্য মরীচিকার পিছনে ছুটলি আর শেষে দেখলি কিছুই পেলিনা। মরূদ্যান তো হাতছাড়া হলই, শেষে দেখবি এক ফোঁটা তৃষ্ণার জলও পেলি না।”
আমি ভয়ে ভয়ে মায়ের ঘরের দিকে তাকালাম,“আহ, আস্তে বল বাবা, মা শুনতে পেলে আবার তোমাদের কথা কাটাকাটি; আমার ভাল লাগেনা বাবা। যাইহোক তুমি কি কিছু খাবে?”
বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে হাসল, “তুই রান্না করবি? রাতে চিকেন আনব নাকি?”
“আমার সোনা বাবা, ভাল বাবা। থ্যাঙ্ক ইউ।”, বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম আমি।
মায়ের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলাম মা তখনও এক মনে খাতা দেখে যাচ্ছে।
তাহলে যাই, মিথিলের বাড়ী। আজকে আমাকে জানতেই হবে এই রূপম নামের ছেলেটা এত ঘুরঘুর করছে কেন?
মিথিলের বাড়ি আমার অবারিত দ্বার।
যেতেই কাকিমা দরজা খুলে হাসি মুখে বললেন, “মহারানী এই মাত্র ফিরেছেন। আয়, ভেতরে আয়।”
(#০৩)
মিথিলের মাকে মানে কাকিমাকে আমার খুব ভাল লাগে। গাঢ় রঙের শাড়ী,কপালে সিঁদুরের টিপ আর গায়ে কেমন যেন মা মা গন্ধ। ছোটবেলাতে যখন আসতাম মিথিলের বাড়ী, সবসময় দেখতাম কাকিমা রান্না করছে, মিথিলকে চান করাচ্ছে, নিজে হাতে ভাত মেখে খাইয়ে দিচ্ছে। মিথিল সবসময় কাকিমার কোলে বাচ্ছার মত গুটিয়ে আছে। ওকে খুব হিংসা হত আমার। কি সুন্দর মাকে ও সবসময় কাছে পায়। ওর মা কি ভাল। আর আমার মা.....
মা মানেই বকা আর পড়তে বসা। চশমার উপর দিয়ে তাকানো এক রাগী ভদ্রমহিলা যাকে আমার বাবাও খুব ভয় পায়। মা কোনদিন আমাকে ওইভাবে ভাত মেখে খাইয়ে দিয়েছে কি? চানের সময় জল ছিটোলে হেসে উঠেছে কি? ঝাল লেগে চোখ দিয়ে জল পড়লে, ও মা, সোনা মায়ের ঝাল লেগেছে, বলে আদর করে জল খাইয়ে দিয়েছে কি? খালি পড়া আর পড়া না পারলে বকুনি। জ্বরের সময় রাগী ডাক্তার, তেঁতো ওষুধ জোর করে খাওয়ানো, পড়ার ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে এই সব জ্বরের অজুহাতে, এই সব বলে ধমকানো।
আমার মা কেন মিথিলের মায়ের মত হল না? মিথিলের মা কি সুন্দর সবসময় ঘরে থাকেন, ও যখন ইচ্ছে ওর মাকে পাশে পেতে পারে, আমি কেন পারি না?
সিঁড়ি ভেঙে ওদের দোতলায় উঠি, মিথিলের ঘর থেকে গীটারের আওয়াজ। বাব্বা, মেয়ে গীটার কিনল কবে? এত বড় সাহস! আমাকে জানালনা, নিজেই কিনে নিয়ে এল? আজ হচ্ছে তোর, দাঁড়া।
“কিরে, গীটার কিনলি, আর আমাকে বললিও না?”, মিথিলের উপর খুব রাগ হল আমার।
গীটার থেকে মুখ তুলে রিমলেস চশমার উপর দিয়ে আমার দিকে তাকাল মিথিল, হাসি ফুটল ওর ঠোঁটের গোড়ায়, “আয়। বস। আজকেই কিনলাম। যাদবপুরে আমার বন্ধুর কাকার গীটারের নিজের ব্যবসা। উনিই এনে দিলেন।”
গীটারের তারে পরম মমতায় হাত বুলিয়ে মিথিল আমাকে জিজ্ঞাসা করল, “কেমন হয়েছে রে ধৃতি?”
“ভাল, খুবই সুন্দর। কিন্তু তুই কি কোথাও শিখতে যাবি গীটার?”, আমিও আলতো হাত রাখলাম গীটারের গায়ে।
“কিট্টু, কিট্টু আমাকে গীটার শেখাবে কি?”, মিথিল আমার হাতটা শক্ত করে ধরল, “তুই বল নারে; ও তোর কথা খুব মানে; তুই বললে আমাকে শিখিয়ে দেবে।”
কেন জানিনা আমার মনে হল কিট্টুর কথা বলতে গিয়ে মিথিলের দু গালে কেমন একটা যেন লাল রঙ খেলে গেল; চোখে একটা কেমন যেন নেশা নেশা, ঘোর ঘোর লাগল ওর।
না না, এটা নিশ্চয়ই আমার চোখের ভুল, তার উপরে মিথিল আবার চশমা পরে। নাহ, আমিই ভুল দেখছি।
এখন একটু বলা উচিৎ কিট্টু নামক মানুষ টি কে। কিট্টুও আমার আর মিথিলের পাড়াতেই থাকে। ভাল নাম প্রত্যুষ। আমাদের সঙ্গেই পড়ত। এখন আমার সঙ্গে এক কলেজে এক ক্লাসেই পড়ে। আমার খুব ভাল বন্ধু। ফাটাফাটি গীটার বাজায়। ওর আদর্শ আমার মা। ও আমার মায়ের মত কলেজের প্রফেসর হতে চায়। ওর বাবা নেই। ওর মা আর আমার মা বাবা ছাড়া একমাত্র আমিই জানি, আমার মা ওর পড়ার সব খরচ চালায়।
- তুই কিট্টু কে বল।
- কি বলব?ও তোর এর ভাল বন্ধু।
- ও তো তোকেও চেনে।
“নাহ, মানে”, মিথিল চশমাটা ডান হাতের তর্জনী দিয়ে উপরের দিকে ঠেলে দিল, “তুই বললে ও না করবেনা। আমি শিওর।”
কাকিমা পিঁয়াজি, রোল পাঁপড় আর কফি দিয়ে গেলেন। স্বভাবতই রাতের খাবারের জন্যও আমাকে আমন্ত্রন করে গেলেন, কিন্তু আমি প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হলাম; বাবাকে কথা দিয়েছি আজ রাতে আমি চিকেন রান্না করে খাওয়াবো। তার চেয়ে এক কাজ করলে হয় না,মিথিলকে আমাদের বাড়ি নিয়ে গেলেই সব সমস্যা মিটে যাবে। এখন তো পড়ার আর সেরকম চাপ নেই, মা নিশ্চয়ই আমাদের বকবে না।
খানিকক্ষণ এদিক সেদিকের গল্প করার পর আমরা আমার বাড়ীতে ফিরে এলাম।
মায়ের ছাত্র-ছাত্রী রা এসে গেছে। বাবা বাড়িতে নেই। মা মিথিলকে আমার সঙ্গে দেখে খুশীই হল, “এস মিথিল, এস।” ওর পড়াশোনা,বাবা মা,সবার কথা জিজ্ঞাসা করার পর মা বলল, “বন্ধুকে একটু বোঝাও। যদি তোমার মত ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে সুযোগ পেয়ে যেত, কত ভাল হত। পাশ করেই চাকরি। ওকে বল এর পরের জয়েন্টটা যেন ভাল করে দেয়। একটু পড়াও ওকে।”, মা কফির কাপ হাতে নিয়ে পড়ানোর ঘরে চলে গেল।
আমরা আমাদের ঘরে এলাম।
- মিথিল, একটু ঝেড়ে কাশ তো। এই রূপম নামের ছেলেটা কে?
- একটা ছেলে। আমার সাথে পড়ে। বাট, আমাদের চেয়ে বড় দুই বছরের। কেন বলতো?
- তুই সেদিন আমার কলেজের সামনে ওই ছেলেটার সঙ্গে কি করছিলি?
- সেদিন বললাম তো তোকে, বই কিনতে গিয়েছিলাম। ও খুব ভাল ছেলে রে।
আমি ভাবলাম ওকে বলা উচিৎ কিনা যে রূপম আমার কলেজের সামনে বারবার ঘুরে বেড়াচ্ছে।
- কিন্তু তুই রূপমের কথা এত জিজ্ঞাসা করছিস কেন?
- নাথিং।
- বলনা প্লীস।
- জানিস,রূপম না আমার কলেজের সামনে বারবার ঘুরে বেড়ায়।আমার না কেমন একটা লাগে।
- না না, ও খুব পড়াকু টাইপ্স; ও বই টই ই কিনতে গেছিল আমি শিওর।
সেদিন চিকেনটা সত্যিই খুব ভাল হয়েছিল; এমনকি মা ও খেয়ে খুব প্রশংসা করল। অবাক হল আমি কিকরে চিকেন রান্না করতে শিখলাম। আমি আর বাবা হাসছিলাম, কারণ আমার ভাল চিকেন রান্নার রহস্য আমার বাবা।
বাবা আমাকে চিকেন রান্না শিখিয়েছে। আরও একজন আছে এর পিছনে, কাকিমা। মানে মিথিলের মা।
মাঝে মাঝে মনে হয় আমার মা আর মিথিলের মা যদি একে অন্যের জায়গায় চলে আসতেন। মা মিথিলের মত মেয়ে পেয়ে নিশ্চয়ই খুব খুশী হতেন। আর আমি কাকিমার মত মা পেয়ে।
সেদিন রাতে ঘুমতে যাবার আগে একটা কথা ঠিক করলাম, আমি রূপমকে আর একবারও আমার কলেজের সামনে ঘুরঘুর করতে দেখলে ওকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করব।
(#০৪)
আজ সকাল থেকেই বৃষ্টির বিরাম নেই। সকালে ওঠার পর বাবা তো বলেই দিল, "খিচুড়ী বানাব। আজকে হিটলার বাড়ি থাকবে না। কলেজে এক্সামের গার্ড আছে।"
কিন্তু কিছু করার নেই, আজকে পিটি স্যারের ক্লাসও আছে। বড্ড বকেন স্যার কামাই করলে। মা সকালেই বেড়িয়ে গেছে। বাবার আজকে সেতার শেখানোর ক্লাস আছে মুদিয়ালিতে। আমি না গেলে বাবাও ডুব মেরে দেবে। নাহ, সেটা হলে ছাত্র ছাত্রী রা খুব মুশকিলে পড়ে যাবে। তাই অগত্যা আমি তৈরী হলাম। কিট্টুর বাড়ীতে খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পারলাম ও আগেই বেড়িয়ে গেছে। ব্যাপার টা কি? ও তো প্রতিদিন আমার সঙ্গে কলেজে যায়। আজকে একা কেন? যাক, যা পারে করুক।
বৃষ্টির জন্য একটু আগেই বেড়িয়েছিলাম। মাঝরাস্তায় সেরকম যানজট না থাকায় নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই পৌঁছে গেলাম কলেজে। বৃষ্টির জন্যই হোক আর উপরের ক্লাসের এক্সামের জন্যই হোক, কলেজ বেশ ফাঁকা। নতুন কলেজ। বেশী এদিক সেদিক যেতে নিজেরও ভয় করে। আর এই সময় ক্যান্টিনে যাওয়াও বেকার একদম। প্রায় জনমানবহীন করিডর দিয়ে একাই হাটতে লাগলাম ক্লাসের দিকে।
কাল মিথিল আমার বাড়ীতেই রাত্রে থেকে গিয়েছিল। আর তাই জানতে পারলাম একটা সত্যি। মিথিল কিট্টুকে ভালবাসে।শোনার পর থেকেই মাথাটা ঝিমঝিম করছে। আমি, মিথিল, কিট্টু আমরা কত ছোটবেলা থেকে একে অন্যকে চিনি, জানি। মিথিল আগে আমার বন্ধু ছিল, আর কিট্টুও। তারপর ওদের আলাপ করাতে ওদের বন্ধু হয়ে যাওয়াটা ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। মিথিল এত ছোট বয়সে ভালবাসার মত এত বড় সিদ্ধান্ত একা একা নিল কি করে? মিথিলের চোখমুখ দেখে তো বেশ সিরিয়াসই মনে হল ওকে। কাল বেচারি অনেক ঝুলোঝুলি করেছে, আমাকে কিট্টুকে বলতে যাতে মিথিলকে কিট্টু গীটার শেখায়। খুব খারাপ লাগছিল আমার, "ঠিক আছে, কালকেই কিট্টুকে বলব আমি।", এই বলে ওকে জোর করে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিলাম।
ও গীটার শেখার ছলে কিট্টুর কাছাকাছি আসতে চাইছে। জানি আমি। কিন্তু আরও যেটা জানি সেটা ওর জলভরা চোখের দিকে তাকিয়ে আমি ওকে বলতে পারিনি, সেটা হল কিট্টু আমাদের ক্লাসের রিয়াঙ্কা বলে একটি মেয়েকে বেশ পছন্দ করে। আর আমি যতই ওকে রাগাই না কেন, এটা আমি কেন গোটা ক্লাস জানে যে কিট্টু রিয়াঙ্কাকে প্রপোস করলেই মেয়েটি নাচতে নাচতে ওর গলায় ঝুলে পড়বে।
কি করব আমি? কিট্টু কে কি মিথিলের অনুভূতির কথা জানিয়ে বলব একবার ভেবে দেখতে?
যত গেরো হয়েছে আমার। এ যেন শাঁখের করাত, আসতে যেতে দুবারই কাটছে। দুজনেই আমার ছোটবেলার বন্ধু, এদের মধ্যে একজনও যদি রেগে থাকে আমার উপর তো আমি কষ্টে শেষ হয়ে যাব।
কি করি ভাবতে ভাবতে ক্লাসের সামনে চলে এলাম। দরজাটা আলতো করে ভেজানো। আমি ফাঁক করতেই যা দেখলাম, তাতে ওখানে দাঁড়িয়েই আমি শ্যামবাজারের পাঁচমাথার মোড়ের নেতাজীর স্ট্যাচুর মত হয়ে গেলাম।
(#০৫)
আমি যা দেখলাম, তাতে শুধু স্তম্ভিতই নয়, অবাকও হলাম।
কিট্টু আর রিয়াঙ্কা চুম্বনরত।
আমি তখন সদ্য আঠারোতে পা দিয়েছি। বলতে সঙ্কোচ নেই, কিন্তু আমার হিটলার মায়ের প্রভাবেই হোক আর নাচ, পড়াশোনার দরুন সময়ের অভাবেই হক, যৌনতা সম্পর্কিত কোন জ্ঞান আমার ছিল না। আমি চুমু বা চুম্বন বলতে বুঝতাম যেমন আমি মাকে বাবাকে চুমু খাই, পুতুলকে আদর করি, সেই রকমই। কিন্তু চোখের সামনে যেটা ঘটে যাচ্ছিল, আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যেন বলে দিচ্ছিল এটা সেরকম নয়, যেকরম আমি এতদিন ধরে জানতাম।
নিজেকে দরজার সামনে থেকে কোনমতে সরিয়ে নেবার আগে কিট্টুর জড়ানো আবেগময় গলা বলে উঠল, "আই লভ ইউ রিয়াঙ্কা"।
আমার মত ডাল মেয়েও এই কথাটার মানে বুঝতে ভুল করবে না। বুঝে গেলাম কিট্টু পাখি রিয়াঙ্কার ঘন কোঁকরানো চুলেই বাসা বেঁধেছে। তার মানে মিথিলকে আজই গিয়ে সাবধান করে দিতে হবে।
চুপচাপ চলে এলাম ওখান থেকে। স্টাফরুমে গিয়ে উঁকি দিলাম, পিটি স্যার নয়, ম্যাথের কোন স্যারই আসেননি আজকে। তারমানে ছুটি, আশা করা যায়। কিন্তু এভাবে একা একা বাড়ী যেতেও ইচ্ছে করছেনা, আবার কলেজেও থাকতে ইচ্ছে করছে না। কি করি?
বাড়ীতে গিয়ে একা একা কিভাবে সময় কাটাব ভাবতে ভাবতে কলেজের গেটের সামনে চলে এসেছি। আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা হলেও কেন জানিনা সামনে আইসক্রীমের গাড়ী দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। সোজা গিয়ে একটা কর্ণেটো কিনে নিলাম। হ্যারি পটার এর পাঁচ নম্বর মুভি রিলিজ করেছে। অনায়াসে কিট্টু আর মিথিল কে নিয়ে যেতে পারতাম; মাও রাগ করত না, কিন্তু মাঝখান থেকে এমন সব গুবলেট হয়ে গেল, আর যেতেই ইচ্ছে করছেনা। কর্ণেটোর কাগজ ছিঁড়ে কামড় দিলাম। আহ, যেন স্বর্গ। এই স্বাদের জন্য সব তুচ্ছ করতে পারি আমি। মন দিয়ে খেতে খেতে ফুটপাথ ধরে হাঁটতে লাগলাম।
"ধৃতি", আমি চমকে উঠলাম।
কে?
আরে, সর্বনাশ আবার রূপম। এই চ্যাপ্টার টার অস্তিত্বের কথা তো বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলাম আমি।
মুখে কর্ণেটো আস্তে আস্তে গলে আমার গলা বেয়ে নেমে যাচ্ছে। আমাকে যেন বৃথা শান্ত হবার অনুরোধ করছে, কিন্তু আমি সেটা গ্রাহ্য করতে পারছি না। কাল অত কিছু বলার পরেও ছেলেটার সাহস আর স্পর্ধা দেখে আমি যাকে বলে একেবারে অ---বাক। নাহ, আজ এর হেস্তনেস্ত করতেই হবে।
কিন্তু আমি কিছু বলার আগেই রূপম বলে উঠল, "দেখ ধৃতি তুমি যদি ভাব যে আমি রবীন্দ্রসদনের অনুষ্ঠান থেকে তোমাকে ফলো করছি, তাহলে তুমি আংশিক ভুল।"
মানে?
আমি আর বেশী অবাক হই, কিন্তু হাতে আইসক্রীম থাকায় নিজের সম্পূর্ণ মনোভাব প্রকাশ করতে ব্যর্থ হই।
"কিন্তু তুমি যদি এটা ভেবে থাক যে শুধু তোমার জন্যই বারবার যাদবপুর থেকে কলেজ স্ট্রীট আসি, তাহলে তুমি আংশিক ঠিক।"
আমি কিছু বলার অবস্থায় ছিলাম না; মনে হচ্ছিল কোনভাবে পালাই এখান থেকে। সেইমত এদিক ওদিক তাকিয়ে এক ছুট লাগানোর চেষ্টা করলাম। এক ছুটে রাস্তা পেরিয়ে সূর্য সেন স্ট্রীটে চলে এলাম। কিন্তু রূপম পিছু ছাড়ল না। এপারে এসে আমার সামনে রাস্তা আটকে দাঁড়াল, "কি পাগলামো হচ্ছে এটা ধৃতি? তুমি আজকে গাড়ী চাপা পড়ে গেলে কি হত?"
এই কথাটা, শুধু এই কথাটা শুনে কি যে হল আমার। এত আপনভাবে, এত মিষ্টি করে, এত অন্তরঙ্গ সুরে তো বাবা ছাড়া আর কেউ কোনদিন আমাকে বকেনি। আমার সামনে থেকে বৃষ্টিভেজা সূর্য সেন স্ট্রীট যেন ধুয়ে মুছে গেল এক নিমেষে। ওই মুহূর্তে যেন ভীষণ আপন মনে হল আমার রূপ কে। আমি এক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম।
"কি হল ধৃতি? উত্তর দাও।", আবার আমার দিকে তাকিয়ে রূপম বলে উঠল, "তুমি আজকে গাড়ী চাপা পড়ে গেলে কি হত?"
"আমার ছবিতে বাবা আর মা মালা দিয়ে কাঁদত।", আমি আনমনেই বলে উঠলাম ওর দিকে তাকিয়ে।
"কি!", রূপম প্রথমে আমার দিকে অবাক চোখে তাকাল, আর তারপর হা হা হা হা করে এত্ত জোরে হেসে উঠল যে আশে পাশের দোকানীরা চমকে তাকাল।
ওর হাসিটা দেখে এক মুহূর্তের জন্য মনে হল, কি নিষ্পাপ, কি মন ভাল করা হাসি হাসতে পারে এই ছেলেটা।
আমিও হেসে উঠলাম।
(#০৬)
ধৃতির কথা তো শুনলাম। কিন্তু ঠিক এই একই সময় রূপম কি ভাবছিল?
রূপমের কথা রূপমের ভাষায়।
রূপমের কথা :
নতুন কলেজে ভর্তি হয়েই যে এত ভাল একটা গ্রুপ পেয়ে যাব, আমি সত্যি ভাবিনি। আসলে চিরকাল আমার বন্ধুভাগ্যটা বিশেষ ভাল না। আর এরা তো আমার থেকে দু বছরের ছোট। অথচ তার পরেও কি সুন্দর একটা বন্ধুদের গ্রুপ পেয়ে গেলাম। আর পেলাম একজন কে, যাকে দেখে মনে হল, এই ই সেই যার জন্য আমি সারাজীবন অপেক্ষা করতে পারি।
সেদিন কলেজে বিশেষ কোন ক্লাস ছিল না। সবাই সিঙ্গেল, তাই মাঠে বসেই আড্ডা জমে উঠল। একদফা গীটার আর গানের পর কার বাবা হিটলার, কার মা পুত্রস্নেহে অন্ধ গান্ধারী; বেশ লাগছিল শুনতে যতক্ষণ না প্রশ্নের অভিমুখ আমার দিকে ঘুরে গেল। কি বলব আমি? কার কথা বলব? আমার তো বাবা, মা কেউ নেই। আমি সেই অর্থে অনাথ। কিন্তু আমার দাদু আছে, দিদা আছে, আর আছে ঠাকুমা। শুনেছি আমার জন্মের আগেই আমার বাবা মারা যান আর আমাকে জন্ম দিয়েই আমার মা। মা আমাকে পৃথিবীর আলো দেখিয়ে নিজেই যে এভাবে চির অন্ধকারের গর্ভে মিলিয়ে যাবে সেটা কেউই ভাবেনি; দাদু, দিদা, ঠাকুমা কেউ না। আর সেই জন্যই আমি আমার মামা, মাসি এদের কাছে ব্রাত্য। আমি দাদু দিদার সাথে এক বাড়ীতে থাকি। আমার ঠাকুমাও একই বাড়ীতে থাকেন। সেই হিসেবে আমার মামারও ওই বাড়ীতেই থাকার কথা, কিন্তু থাকেনা। কারণ আমি। তাই ওটা আমার মামার বাড়ী নয়; আবার বাবার বাড়িও নয়।
কিন্তু এত সব কথা নতুন কলেজের নতুন বন্ধুদের বলা যায় কি? ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ মিথিল এসে আমাকে বাঁচিয়ে দিল। মিথিল আমার বন্ধু নীলাদ্রির বন্ধু। ও মাঠে এসেই আমাদের তাড়া দিল, "ওই, শোন আজকে রবীন্দ্রসদনে শাপমোচন আছে। কেউ যাবি?"
নীলাদ্রি ফুট কাটল, "কার শাপমোচন হবে রে? তোর? তা, কে শাপ দিল তোকে?"
"আমার নয়; বাসবী নৃত্যমন্ডলী বলে একটা ডান্স স্কুল আছে। তারাই অ্যারেঞ্জ করেছে। আমার বন্ধু ওখানে কমলিকা হচ্ছে। তাই আমি তো যাচ্ছি। তোরা কেউ যাবি কিনা বল। টিকিটের প্রবলেম নেই। ভি আই পি কার্ড আছে।"
ওকে খুব এক্সাইটেড লাগছিল। বেশ একটা দোনমন ভাব দেখা দিল সবার মধ্যে। আমার বাড়ীর কথা ওঠার জন্য এমনিতেই মনটা ভাল ছিল না, তাই ভাবলাম ওর সঙ্গে সদনে যাই। যদি প্রোগ্রাম ভাল না লাগে তো বাইরে চলে আসব। নন্দনের সিঁড়িতে বসেই সন্ধ্যেটা কাটিয়ে দেব।
"আমি যাব", আমি উঠে পড়লাম।আমার দেখা দেখি নীলুও উঠল, "তাহলে আর কি, আমিও যাব"।
দেখতে দেখতে শাপমোচন দেখতে যাবার জন্য ছয় জনের একটা গ্রুপ হয়ে গেল,তাই মাঠের আড্ডা ওখানেই ইতি।
শাপমোচন এর শাপ শুরু হতেই মিথিল দেখাল ওর বন্ধু কে। ধৃতি, ওর বন্ধুর নাম ধৃতি। কি এমন আহামরি নাম, ধৃতি। কিন্তু কানে কি মিষ্টি শোনাল আমার। মনের গীটারের তারে কেউ টং করে শব্দ করল। ধৃতি ধৃতি ধৃতি..... বারবার আমি মনে মনে নামটা উচ্চারণ করলাম, ধৃতি ধৃতি ধৃতি।
আমাদের যাদবপুরে সুন্দরী মেয়েদের কোন অভাব নেই। শুধু সুন্দর নয়, এক এক জন আছে, সেক্স বম্ব।
কিন্তু ধৃতি যেন একদম আলাদা। নাচের কিছুই বুঝি না। কিন্তু আমার মত গাড়লও বুঝতে পারল মেয়েটি অসম্ভব মন দিয়ে নাচে। কমলিকার সঙ্গে যেন একাত্ম হয়ে গিয়েছিল ধৃতি।
আর আমি?
ক্লীন বোল্ড!
শুধু হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছিল।
সাজপোশাকে যেন রাজেন্দ্রানী, অথচ দৃষ্টি মাটির দিকে।
অনুষ্ঠান শেষ হবার পরেও আমি নিজের মুগ্ধ দৃষ্টিকে সম্বরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছিলাম। আমার চোখ ওকেই অনুসরণ করে যাচ্ছিল।
আমাদের সবার সঙ্গে মিথিল ওর আলাপ করিয়ে দিল। সবার শেষে আমার পালা। ওর হাত টা হাতে আসার পর আমার সত্যি আর ওর হাত টা ছাড়তে ইচ্ছে করছিল না। মনে হচ্ছিল এভাবেই অনন্ত কাল আমি ওর হাতটা ধরে থাকি, আর ও আমার দিকে তাকিয়ে থাকুক। শেষে নীলাদ্রির চিমটি আমাকে বাস্তবের জগতে এনে দিল।
নাহ, ধৃতিকে ছাড়া আমি বাঁচব না। ওকে আমাকে প্রোপস করতেই হবে। প্রেম না হক, বন্ধুত্ব তো করতেই হবে।
একেই বোধহয় বলে লভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট।
সেইদিন টা যে কি অসহ্য যন্ত্রনায় কেটেছে আমার, আমিই জানি। পরের দুটো দিনও একই অবস্থা।
শেষে আর থাকতে না পেরে মিথিলের শরণাপন্ন হলাম। ধৃতির ব্যাপারে ছোট্ট ছোট্ট অনেক তথ্য দিল ও আমাকে। সুযোগ খুঁজছিলাম আমি কিভাবে যাওয়া যায় কলেজ স্ট্রীট, ধৃতির কলেজের কাছে। আর সঙ্গে সঙ্গেই পেলাম এক লোভনীয় প্রস্তাব মিথিলের কাছ থেকে।
"এই রূপম, আমি আজকে একটু বই কিনতে কলেজ স্ট্রীট যাব। তুই যাবি আমার সাথে?"
আমি সাগ্রহে ওকে হ্যাঁ বলে দিলাম। যেখানে কোন সুযোগই ছিল না,সেখানে একটা সুযোগ তো পেলাম। কথা না হোক,অন্তত দেখতে যদি পাই ধৃতিকে। ওদের কলেজের সামনের বইয়ের দোকানটায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম আমরা। তবে মিথিলকে দেখে কেন জানিনা মনে হচ্ছিল, শুধু বই না, যেন অন্য কোন কিছু এখানে ওকে টেনে এনেছে। প্রেমে পড়েছি আমি। ধৃতির কলেজের দিকে হাঁ করে চাতকের মত তাকিয়ে আছি আমি, কিন্তু আমার সাথে সাথেই আরও একজন মাঝে মাঝেই কলেজের গেটের দিকে তাকাচ্ছে কোন বিশেষ প্রত্যাশায়, হয়ত বা কাউকে দেখার আশায়।
আর সে হল মিথিল।
যাক অবশেষে ধৃতির দেখা পেলাম আমি। ও এল, মিথিলের সাথে কিছু কথা বলেই বাড়ীর দিকে রওনা হল। আমাকে পাত্তাই দিল না।
ঠিক আছে। আমিও রূপম। দেখি কতদিন আমাকে না দেখে চলে যায় ধৃতি।
এর পর শুরু হল আমার মিশন ধৃতি।
আমি রোজই দাঁড়িয়ে থাকি ওর কলেজের সামনে। ধৃতিকে আমায় বলতেই হবে।
(#০৭)
ও কলেজে ঢোকে কখন জানিনা কারণ আমার এখানে আসতে আসতে প্রায়শই দুপুর হয়। তবে ভাগ্যিস সেদিন সকাল সকাল এসেছিলাম, তাই ওর সাথে দেখাও হল আর কথাও হল।
আমার ধৃতির কথা কিছু বলি এবারে। ও কলেজে আসে বেশিরভাগ দিনই লং স্কার্ট আর টপ পরে। আর ওর চুল... আমি ওর চুলেই ফিদা হয়ে গেছি। এখন কার মেয়েরা যেখানে সবসময় ছোট চুলেই অভ্যস্ত, অনেকেই বড় চুল সামলাতে পারে না বলে, সেখানে ওর লম্বা ঘন রেশমী চুল আমার হৃদয় কে কালো জালের মত আটকে রেখেছে।
ওর হাবভাব অনেকটা বাচ্ছাদের মত। কলেজ থেকে বেড়িয়েই আইসক্রীম খেতে হবে ওকে। ওর পছন্দের আইসক্রীম মনে হয় কর্ণেটো। যখনই কেনে এই একটা আইসক্রীমই কেনে। কর্ণেটো কিনে কিনেই মনে হয় ওদের কলেজের সামনের আইসক্রীম বিক্রেতাকে বড়লোক করে দিয়েছে আমার ধৃতি। মনে দিয়ে নাচ করার মত ধৃতি কর্ণেটোও খুব মন দিয়ে খায়।
ওর আরও কিছু কিছু অভ্যাস নজরে এসেছে আমার। বাচ্ছাদের মত দুদিকে জোরে জোরে মাথা নাড়িয়ে না বলা; কোন কথা শুনে অবাক হলে বড় বড় দুটো চোখের ওইভাবে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা; মুখের সামনে সময় অসময়ে চলে আসা ছোট ছোট চুলের গুচ্ছকে শুধুমাত্র বাঁ হাতের তর্জনীর সাহায্যে কানের পাশে লুকিয়ে রাখা; কোন কথা শুনতে শুনতে কানের দুল নিয়ে খেলা করা। ও তো নাচ করে, তাই মনে হয় ওর প্রত্যেকটা ভঙ্গিমাই কি রকম অপ্সরার মত। হাত বাড়িয়ে বই নেওয়া হোক আর আচার খেয়ে "উফ, কি দারুণ" বলা। আমার সবই খুব খুব খুউব ভাল লাগে। মনে হয় এভাবেই লুকিয়ে লুকিয়ে ওকে দেখি আজীবন।
তবে আর বেশিদিন আমি টানতে পারব না কারণ আমারও কলেজ আছে, পড়াশোনা আছে। আমাকে যে নিজের পায়ে দাঁড়াতেই হবে। যারা আমাকে ব্রাত্য করে রেখেছে তাদের কাছে নিজেকে প্রমান করতেই হবে। আমার দাদু দিদা আর ঠাম্মা কে যারা দোষ দেন আমাকে লালন পালন করার জন্য তাদের সবাইকে দেখাতে হবে। আমাকে যাদবপুরে ফার্স্ট হতেই হবে। এম টেক করতে হবে। আমি কিছুতেই হারব না।
সেদিন আলাপ বাড়াতে গিয়েও পারিনি, কিন্তু আজকে পারতেই হবে আমাকে। এমন ভাবে বলল ও যে আমার সঙ্গে আলাপ বাড়াতে চায় না, মনে খুব কষ্ট হয়েছিল, প্রায় কান্না পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম এইরকম কত কিছু বলবে ও, কিন্তু আমাকে আমার লক্ষ্যে অর্জুনের মত স্থির থাকতে হবে। আজ ও আমাকে কিছু বলার আগেই আমাকে বলে ফেলতে হবে।
আজ খুব বৃষ্টি পড়ছে, আর এই বৃষ্টি মাথায় করেই আমি বেড়িয়েছি, আজকে আমি আমার মনের কথা ধৃতিকে জানাবই। তাই ভেবে সাড়ে নটার মধ্যেই পৌঁছে গিয়েছিলাম ওর কলেজের সামনে। আমার সামনে দিয়েই কলেজে ঢুকল ও।
চুপচাপ একটা সিগারেট ধরালাম; কিন্তু তারপরেই মাথায় এল নীলাদ্রির সাবধান বানী, সিগারেট খেয়ে কোন মেয়েকে প্রোপস করতে যাস না। মুখে গন্ধ পেলে হ্যাঁ তো বলবেই না উলটে চারটে বাজে কথা শুনিয়ে দেবে। মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সিগারেটটা মাটীতে ফেলে দিলাম।
আরে, এই তো ঢুকল, এর মধ্যেই বেড়িয়েও এল? একটা চুইংগাম কিনে মুখে পুরে ওর পিছন পিছন হাঁটতে শুরু করলাম।
সেই কর্ণেটো কিনেছে, আর খেতে খেতে এদিক ওদিক চাইতে চাইতে হাঁটছে।
মনের সব সাহস সঞ্চয় করে ওর পিছনে গিয়ে ডাকলাম, "ধৃতি"।
উফ,সেই বড় বড় খয়েরী মণির দুটো চোখ; অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
ওকে কিছু বলার আগেই বললাম, "দেখ ধৃতি তুমি যদি ভাব যে আমি রবীন্দ্রসদনের অনুষ্ঠান থেকে তোমাকে ফলো করছি, তাহলে তুমি আংশিক ভুল।', এক মুহূর্ত থেমে বললাম, "কিন্তু তুমি যদি এটা ভেবে থাক যে শুধু তোমার জন্যই বারবার যাদবপুর থেকে কলেজ স্ট্রীট আসি, তাহলে তুমি আংশিক ঠিক।"
এরপর ও যা করল তার জন্য আমি একদমই প্রস্তুত ছিলাম না। একছুটে রাস্তা পেরিয়ে একদম সূর্য সেন স্ট্রীটে। আরে আরে, মেয়ে করে কি? রাস্তায় এত গাড়ী, তার মধ্যে এইভাবে কেউ ছুটে রাস্তা পার হয়? স্কার্টে পা আটকে যদি মাঝ রাস্তায় পরে যেত? ট্রাম আছে,গাড়ি আছে। কি যে করে না। একদম বাচ্ছা মেয়ে। আমিও ওর পিছনে ছুটে এইপারে এলাম। ওকে ধরে বকব ভাবছিলাম; বললামও, "কি পাগলামো হচ্ছে এটা ধৃতি? তুমি আজকে গাড়ী চাপা পড়ে গেলে কি হত?"
আবার নিজের প্রশ্ন রিপিট করলাম।
কিন্তু ও তার উত্তরে যা বলল, আমি শুনে আর হাসি থামাতে পারলাম না। বলে কি না, "আমার ছবিতে বাবা আর মা মালা দিয়ে কাঁদত।"
আমার হাসি দেখে কন্যেও হেসেছেন অবশেষে।
যাক, আজ অন্তত আমাকে ঝাড়বে না।
আমরা হাঁটতে শুরু করলাম কলেজ স্কয়ার কে ডানদিকে রেখে।
- তুমি এভাবে ছুটলে কেন ধৃতি?
- তুমি আমাকে এভাবে ফলো করছে কেন রূপম?
- এটা কি আমার প্রশ্নের উত্তর?
- লেডিস ফার্স্ট।শোননি?
- প্রশ্ন টা আগে আমি করেছি।
ধৃতি আমার দিকে ফিরে বলল, "আগে বল। আমাকে কেন ফলো করছ?"
সামনেই কফি হাউস।" আমি মিথিলের বন্ধু, মানে তোমারও। এক কাপ কফি খাবে আমার সঙ্গে?প্লীস।", আমি ওকে অনুরোধ করলাম।
কফি?ধৃতি একটু ঠোঁট উল্টাল, ডানদিকের চুলগুলোকে কানের পাশে পাঠিয়ে বলল, দশ মিনিট। তার বেশিক্ষণ সময় দিতে পারব না।
তবে তাই কর। চল।
ধৃতি এককাপ কফি নিল, আর কিছু না।
আমি একটু এদিক ওদিক দেখে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, "আমি রূপম।"
ধৃতি আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল, তারপর বলল, "ভাগ্যিস বললে। তাই জানলাম তোমার নাম রূপম"।
- তুমি খুব ভাল নাচ ধৃতি।
- তুমি কি আমার কাছে নাচ শিখবে? আমি বাসবী দিকে বলে দেব। ওনার ছেলেই তো ছেলেদের শেখান। ব্যাচও আছে আলাদা। কবে থেকে শিখবে?
আমি হাসতেও পারলাম না যদিও পেট গুলিয়ে হাসি আসছিল। কি মেয়ে রে বাবা। কিচ্ছু বোঝেনা নাকি?
"না, মানে তা নয় ঠিক। তোমার নাচে ঈশ্বরকে উপলব্ধি করতে পেরেছি।"
(#০৮)
ধৃতির কথা:
ওর কথা শুনে কিছুক্ষণ কথা বলার অবস্থায় ছিলাম না আমি। কমপ্লীমেন্ট জীবনে অনেক পেয়েছি আমি, তবে এটা বোধহয় আমার জীবনের সব থেকে সেরা কমপ্লিমেন্ট। আমি চুপ করে তাকিয়ে থাকলাম ওর দিকে।
ও আমার চোখে চোখ রেখে চুপ করে বসে রইল।
ধৃতি, কফিটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে; খাবেনা তুমি?
আমি আর পারলাম না, হেসে ফেললাম, "এটা বলবে বলে কফি হাউসে নিয়ে এলে?"
রূপম হাসল। না,যেটা একটু আগে বললাম সেটাই বলতে এসেছিলাম। আর একটা কথা ছিল,য দি শুনে আমাকে লোক ডেকে না পেটাও তাহলে বলতে পারি।
আমি কফির কাপে চুমুক দিলাম, বল।
রূপম অনেকক্ষণ চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, আমি তোমাকে ভালবাসি ধৃতি।
খুব জোরে একটা বিষম খেলাম আমি, ভালবাসা! ওহ,যেটা থেকে বারবার মা এত দূরে থাকতে বলেছিল, সেটাই দরজায় এসে কড়া নাড়ল।
কিন্তু কেন জানিনা আমার ভিতরের অন্য আমিটা আমাকে ওর মুখের উপর না বলতে আটকে দিল।
মনে আমার রঙ লেগেছিল, সত্যি,স্বীকার করতে লজ্জা নেই। রূপম কে বললাম, "আমি কি করব?"
রূপম আমার দিকে তাকাল, উফ, ছেলেটা যে কেন এভাবে আমার দিকে তাকায়, আমার কেমন যেন হয়।
নাহ, আর না। শোন আমি এসব ব্যাপারে কিছু ভাবিনি এখনও।
"তো? তুমি খুব স্পেশাল জান। যেদিন তোমাকে প্রথম দেখি সেদিন আমার জন্মদিন ছিল।" রূপম চশমার উপর দিয়ে তাকাল আমার দিকে, এখনও ভাব নি মানে এর পরেও কি ভাববে না? এরকম কোন কথা আছে কি?
- না, নেই। আমার খুব ভয় করে।
- কেন?
- কি জানি
- বল না ধৃতি।
- ভয় হয় যদি তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাও।
জানিনা কেন এরকম কথা আমার মুখ দিয়ে বেরল, কিন্তু কথাটা বলার পরে আমার লজ্জার শেষ ছিল না। ধ্যাত, কি বোকা আমি,এভাবে কেউ বলে?
- যদি বলি কোনদিন ছেড়ে যাব না? তাহলে?
- না রূপম আমি সত্যি ওভাবে বলতে চাইনি। আমি ঠিক কোন রিলেশনশিপের জন্য প্রস্তুত নই এখন।
প্লীস ধৃতি, রূপম আমার হাতে হাত রাখল, একবার আমার সাথে জীবনের পথে চলেই দেখ না কেমন লাগে?
(#০৯)
তিন মাস পর~~~
আজ প্রায় তিন মাস হয়ে গেছে ওদের সম্পর্কের। আজকে রূপম আসবে ধৃতির বাড়িতে। ধৃতির মা ওকে মেনে নিয়েছে। বাবা তো খুব খুশি। তাই সকাল থেকেই ধৃতি খুব ব্যস্ত।
বারবার সামনের বড় রাস্তায় চোখ চলে যাচ্ছে, কখন আসবে ওর রূপ?
এগারোটা নাগাদ ওকে দেখতে পেল ধৃতি ওকে। আসছে। ধৃতির জন্য হাতে লাল গোলাপের স্তবক। ধৃতির খুব প্রিয়।
হঠাত একটা বড় ট্রাক রূপমের সামনে চলে এল; রূপম নিজেকে সামলাতে পারল না। ওকে ট্রাকটা পিষে দিয়ে চলে গেল। ঘাতক ট্রাকটা বেশি দূর যেতে পারে নি, ট্রাফিক পুলিশ ধরেছে ওটা কে। মাতাল ড্রাইভার কে নামিয়েছে সবাই, কিন্তু এসব ছাপিয়ে সবার চোখ চলে যাচ্ছে রক্তাক্ত সেই মৃতদেহের হাতে ধরা লাল গোলাপের স্তবকের দিকে। ধৃতি ছুটে এসেছে আর সাথে ওর বাবা মাও। রূপমের মৃতদেহের উপর ঝাপিয়ে পড়েছে ধৃতি। বারবার নাকের কাছে হাত নিয়ে গিয়ে দেখছে নিশ্বাস পড়ছে কি না। রক্তে লাল হয়ে যাচ্ছে ধৃতির সাদা চুড়িদার। আর ওর কান্নায় ধুয়ে যাচ্ছে রূপমের মুখের পাশে লেগে থাকা রক্ত।
*********সমাপ্ত*********