কাজল নদী_Written By Tumi_je_amar [তৃতীয় পরিচ্ছদ – কালবৈশাখী (চ্যাপ্টার ০১ - চ্যাপ্টার ০৭)]
কাজল নদী
Written By Tumi_je_amar
তৃতীয় পরিচ্ছদ – কালবৈশাখী
(#০১)
একসময় মানসীর কলেজ শেষ হয়। ১৯৮৭ সালের শেষের দিকে ওর রেজাল্ট বের হয়। মানসী ৭১% নম্বর নিয়ে বাংলায় গ্রাজুয়েশন পাশ করে। মানসীর ইচ্ছা ছিল এম.এ. পড়বে। কিন্তু দাদা খরচ করতে রাজী হয় না। আর ওর বাবা বলেন মেয়েদের বেশী পড়ে কি হবে।
সুলগ্না বৌদি বড়দাকে অনেক বলেন মানসীকে এম. এ. পড়তে দেবার জন্য। কিন্তু বড়দা বা মানসীর বাবা কিছুতেই মেনে নেন না। মানসীর বাবা বলেন বেশী পড়াশুনা করে মেয়েদের কাজই বা কি ! তার থেকে বিয়ে দিয়ে দাও। চার পাঁচটা বাচ্চা হোক। ছেলে মেয়েদের মানুষ করুক। ব্যস হয়ে গেল।
সুলগ্না বৌদি মানসীকে কোন একটা স্কুলে কাজ জোগাড় করতে বলে। এই সময় কস্তূরী মানসীকে সাহায্য করে। কস্তূরী ওর বাবাকে বলে একটা প্রাইভেট স্কুলে মানসীর জন্য বাংলা শিক্ষিকার কাজ জোগাড় করে দেয়। একদিন মানসী স্কুল থেকে ফিরলে সুলগ্না বৌদি ওকে ডাকে। বৌদি মানসীকে একটা কাগজ দেয় আর বলে সাবধানে লুকিয়ে রাখতে।
মানসী – এটা কি বৌদি ?
সুলগ্না – এটা এক লক্ষ টাকার ফিক্সড ডিপোজিট – এর কাগজ। তোমার নামে করেছি। তুমি পাশ করেছ তাই উপহার দিলাম।
মানসী – তা বলে এতো টাকা ! আর বৌদি আমি টাকা দিয়ে কি করবো ?
সুলগ্না – এই টাকা যে আমি তোমাকে দিলাম সেটা তোমার দাদা, বাবা, মা কাউকে বলবে না।
মানসী – কিন্তু কেন ?
সুলগ্না – দেখো তোমার কোন দাদাকেই আমার ভরসা হয় ন। যে যার নিজের স্বার্থ বোঝে। তুমি সাধা সিধে মেয়ে, নিজের স্বার্থ একটুও বোঝো না। তোমার কি হবে সে নিয়ে কেউ ভাববে বলে আমার মনে হয় না। এই টাকাটা রাখ, সময়ে অসময়ে কাজে লাগবে।
মানসী ওর বৌদিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। মানসী বুঝত যে কেউ ওকে নিয়ে সেরকম চিন্তা করে না। কিন্তু নিজের জন্য কিছু আদায় করে নেওয়া ওর ধাতে নেই। ও জানত যে ওর বৌদিই শুধু ওর জন্য চিন্তা করে, তা বলে এতোটা মানসীও আশা করতে পারেনি। ও কাগজগুলো বৌদির কাছেই রেখে দিতে চায়, বলে যে ও পরে নিয়ে যাবে। কিন্তু সুলগ্না বৌদি তাতে রাজী হয় না। জোর করে মানসীকেই দিয়ে দেয়।
স্বপনের সাথেও অনেকদিন দেখা হয় নি। ও একটু ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, এদিকে বেশী সময় দিতে পারে না। কিন্তু মানসী বুঝতে পারে স্বপন ইচ্ছা করেই আসে না। এর জন্য মানসী নিজেকেই দায়ী করে। স্বপনকে কোন দোষ দেয় না। আর কোন মেয়ে যাকে ভালবাসে, তার দোষ থাকলেও দোষ দেখে না। তাই এক্ষেত্রে মানসী বোঝে ওরই দুর্বলতার কারণে স্বপন আসে না। ও ভাবে একবার নিহারিকার সাথে কথা বলবে।
কাকতালীয় ভাবে স্বপন আর নিহারিকা তার পরেরদিন ওদের বাড়ি আসে। স্বপন মানসীকে পাশ করার উপহার দিতে এসেছিলো। স্বপন ওকে একটা কৃষ্ণের মূর্তি উপহার দেয়। সবাই বলে শুধু কৃষ্ণ কেন, রাধা কোথায় গেল?
স্বপন বলে যে ও রাধাকে খুব একটা পছন্দ করে না। যে মামীমা নিজের স্বামীকে ভুলে ভাগ্নের পেছনে ঘুরে বেড়ায় তাকে আর যাই হোক ভক্তি করা যায় না।
শ্রেয়সী এই নিয়ে তর্ক করতে যাচ্ছিল কিন্তু বড়দা থামিয়ে দেন।
বড়দা – আমরা এই বিষয় নিয়ে এখানে আলোচনা করবো না। স্বপনের শুধু কৃষ্ণ পছন্দ তাই ও সেটা উপহার হিসাবে নিয়ে এসেছে। মানসী এটা নিয়ে তোমার পুজার আসনে রেখে দাও।
স্বপন – বড়দা আপনি কি একটু রাগ করেছেন ?
বড়দা – না ভাই। তোমার চিন্তাতে অনেক যুক্তি আছে। কিন্তু এখানে কারো তোমার কথার তাৎপর্য বোঝার মতো ম্যাচিওরিটি নেই।
স্বপন – মানসী বোঝে
বড়দা – আমার মনে হয় আমার বোন দের আমি তোমার থেকে একটু বেশী দিন ধরে জানি।
স্বপন আর কথা বাড়ায় না। বড়দার অনেক বুদ্ধি। উনি বোঝেনও সব কিছু। শুধু নিজের ইগো আছে সেটা বোঝেন না। স্বপনও বড়দার সাথে বেশী কথা বলে না। বড়দা একটু পরে “আমার একটা মিটিং আছে” বলে চলে যান।
স্বপন মানসীদের সাথে ওদের ছাদে যায়। ওদের ছাদটা খুব সুন্দর। ছাদ ভর্তি তবে ফুলের গাছ। সব বড়দা দেখাশোনা করে। ততক্ষনে নিহারিকা কস্তূরীকে ডেকে এনেছে। কস্তূরীর বাড়ি ওদের বাড়ির কাছেই। কস্তূরী আসলে স্বপন ওকে একটা বারবি ডল উপহার দেয়। কস্তূরীও বি এ পাশ করেছিল।
শ্রেয়সী জিজ্ঞাসা করে ওর জন্য স্বপন কি এনেছে। স্বপন বলে যে যেদিন শ্রেয়সী বিএ পাশ করবে সেদিন উপহার দেবে। শ্রেয়সী মনঃক্ষুন্ন হয়ে নিচে চলে যায়।
নিহারিকা বলে স্বপনের কিছু একটা উপহার শ্রেয়সীর জন্যেও আনা উচিত ছিল।
স্বপন – আমি যদি আজ শ্রেয়সীর জন্য কোন উপহার আনতাম তবে মানসী আর কস্তূরীর কৃতিত্বকে ছোটো করে দেখা হত।
নিহারিকা – তোমার সাথে তর্ক করাই বৃথা
স্বপন – অন্য সময়ে শ্রেয়সীর জন্য কিছু উপহার নিয়ে আসলেই হবে।
সেদিন কিছুক্ষন গল্প ওরে স্বপন চলে যায়। ও মানসী বা কস্তূরী কাউকেই জড়িয়ে ধরে না। শুধু হাত মিলিয়ে বিদায় নেয়। যাবার সময় মানসীকে নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে বলে যায়।
(#০২)
এর দুদিন পরেই সকাল বেলা সুলগ্নার খুব জ্বর। বড়দা প্যারাসিটামল খাইয়ে দেন।
মানসী – দাদা একবার ডাক্তার দেখালে হত না ?
বড়দা – কিচ্ছু হয়নি। এক ঘণ্টা পরেই ঠিক হয়ে যাবে।
বড়দা অফিসে চলে যান। শ্রেয়সীর এইসব নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই। ও সকালে পুজা করে গান শিখতে চলে যায়। মানসী বলে ও স্কুলে যাবে না, বৌদির পাশে থাকবে।
সুলগ্না – না না, আমার কিচ্ছু হবে না। তোমার নতুন চাকরি, এই সময় কামাই করো না।
মানসী আরও এক ঘণ্টা সুলগ্নার পাশে থাকে। ওর জ্বর একটু কমলে মানসী স্কুলে যায়। স্কুলে যাবার আগে ও নিহারিকাকে ফোন করে দেয়। সেদিন নিহারিকা ফ্রী ছিল, তাই ও চলে আসে। সারাদিন সুলগ্নার জ্বর একবার কমে আবার বেড়ে যায়। নিহারিকা বোঝে কিছু একটা গুরুতর সমস্যা হয়েছে। ও রাঁচিতে স্বপনের সাথে ফোনে কথা বলার চেষ্টা করে, কিন্তু তখনকার দিনের আমাদের দেশের টেলিফোন ব্যবস্থা সেই চেষ্টাকে সফল হতে দেয় না। ও সুলগ্না কে একবার প্যারাসিটামল দেয়। কিন্তু পাঁচ ঘণ্টার কম সময়ে সেটাও দেওয়া যায় না। ও সুলগ্নার কপালে জলপট্টি দেয়, মাথা ধুইয়ে দেয়। কিন্তু বাড়ীতে আর কেউ ছিল না যাকে নিয়ে ডাক্তার ডাকতে পারে।
বিকালে মানসী ফেরে। ও ফিরেই সুলগ্নার অবস্থা দেখে বড়দার অফিসে খবর দেয়। বড়দা যখন বাড়ি পৌঁছায় সুলগ্না তখন পুরো পুরি অজ্ঞান হয়ে শুয়ে আছে।
বড়দা এসেই হৈচৈ চেঁচামেচি শুরু করে দেয়। কেন ওনাকে খবর দেওয়া হয়নি। কে খবর দেবে সেটা চিন্তা করেন না। উনি সুলগ্না বৌদিকে সামনের একটা নারসিং হোমে নিয়ে যান। সেই নারসিং হমের ডাক্তার বলেন কিছু পরীক্ষা করতে হবে কিনবে ওই নারসিং হোমে সেই পরিক্ষার ব্যবস্থা নেই। ডাক্তার বলেন কোন বড় নারসিং হোমে নিয়ে যেতে, কারন প্রাথমিক ভাবে ওনার খুব একটা সুবিধা জনক লাগছে না।
বড়দা বাইরে এসে একটু খবর নেন কোন নারসিং হোম ভাল কিন্তু কম খরচের। অনেক চিন্তা ভাবনা করে মানিকতলার একটা নারসিং হোমে নিয়ে যান। খুব একটা সস্তা নারসিং হোম নয় কিন্তু ওনার কাছে আর কোন উপায় ছিল না। ওখানে সুলগ্না বৌদিকে সাথে সাথে ভর্তি করে আর রক্ত আর আনুসঙ্গিক পরীক্ষা করতে দিয়ে দেয়। চিকিৎসাও শুরু করে।
সুলগ্না বৌদির জ্ঞ্যান ফিরে আসে।
(#০৩)
সুলগ্না বৌদি জ্ঞান ফিরতেই চারদিকে তাকিয়ে দেখে কে কে আছে। তখন মানসী আর নিহারিকা বৌদির কাছে ছিল। বড়দা ডাক্তারদের সাথে কথা বলছিলেন।
সুলগ্না – রাঙা দিদি আমি না থাকলে আমার মেয়েকে দেখো
মানসী – তুমি থাকবে না মানে ? এমনি জ্বর হয়েছে, কিছু একটা ইনফেকশন হয়েছে। দুদিন অ্যান্টিবায়োটিক খেলে আর বিশ্রাম নিলে ঠিক হয়ে যাবে।
নিহারিকা – বৌদি তোমার কি শরীর খুব খারাপ লাগছে ?
সুলগ্না – না এখন ভালই লাগছে। কিন্তু আমার মন বলছে আমি আর বাঁচব না।
নিহারিকা – তোমার কিচ্ছু হয়নি। খাটা খাটুনি বেশী করো, কোন বিশ্রাম নাও না, তাই এইরকম শরীর খারাপ লাগছে।
সুলগ্না – তা হলেই ভাল।
মানসী – বড়দাকে ডাকি ?
সুলগ্না – তোমাকে যে টাকা দিয়েছি, সেটা ঠিক করে রাখবে। এই নিহারিকা জানল, আর কেউ যেন না জানে।
মানসী – এমন করো না, তোমার কিচ্ছু হয়নি।
সুলগ্না – নেহা আমি না থাকলে তুমি তোমার দাদাকে আর একটা বিয়ে করতে বল। না হলে আমার মেয়েকে কে দেখবে ?
নিহারিকা – আচ্ছা সে দেখা যাবে।
সুলগ্না – তোমার বড়দাকে ডাকো।
মানসী গিয়ে বড়দাকে ডেকে আনে। বড়দা এসে মুখ কালো করে সুলগ্না বৌদির মাথার কাছে বসেন। বৌদির হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে চুপ করে বসে থাকেন। চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল গরিয়ে পড়ে।
সুলগ্না – কাঁদছ কেন ?
বড়দা – কিছু না, এমনি
সুলগ্না – তোমাকে কোনদিন কাঁদতে দেখিনি, তাই অবাক লাগছে
বড়দা – তোমার যে কোনদিন এই রকম শরীর খারাপ হতে পারে সে কথাটাই কোনদিন ভাবিনি।
সুলগ্না – ডাক্তার কি বললেন
বড়দা – কিছু বলেনি এখনও, মনে হয় সব ঠিক আছে
বড়দা কথা বলতে বলতে কেঁদে ফ্যালেন। মানসী, নিহারিকা বা সুলগ্না সবাই বোঝে যে বড়দা সত্যি কথা বলছেন না।
সুলগ্না – আমার অসুখের সময় তুমি যদি এভাবে ভেঙ্গে পড় তবে বাকি সবাইকে কে দেখবে
(#০৪)
মানসী আর নিহারিকা ওদের দুজনকে একা রেখে বাইরে যায়। বাইরে মানসীর এক জামাইবাবু ছিলেন। উনি বলেন যে বৌদিকে আর ফেরানো যাবে না।
মানসী – কি হয়েছে বৌদির ?
জামাইবাবু – খুবই খারাপ খবর
নিহারিকা – কি ?
জামাইবাবু – কাউকে বলবি না আর একটুও কাঁদবি না
মানসী – ঠিক আছে, কিন্তু তুমি বল বৌদির কি হয়েছে ?
জামাইবাবু – লিউকিমিয়া বা ব্লাড ক্যানসার। একদম শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
মানসী আর নিহারিকা চেঁচিয়ে ওঠে আর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। জামাইবাবু বা আর যারা ছিল তারা এসে ওদের শান্ত করে। জামাইবাবু ওদের বোঝায় যে বৌদি যেন না জানে। তবে যে কদিন বেঁচে আছেন সে কটা দিনও শান্তিতে থাকবে না।
ওরা দুজন বাইরে এক কোনায় চুপ করে বসে থাকে।
বড়দা এসে ওদের আবার ডেকে নিয়ে যায়, সুলগ্না বৌদি ওদের ডাকছে তাই।
সুলগ্না – তোমাদের দেখে বুঝতে পাড়ছি ভয়ানক কিছু একটা হয়েছে
নিহারিকা – না না বৌদি বাইরে একজন রুগি কে দেখে খুব খারাপ লাগছিলো, রাঙা দিদি তো সেই রুগি কে দেখে কেঁদেই ফেলেছে।
সুলগ্না – আমি তোদের বৌদি। আমি তোদের কে অনেক বেশী জানি।
মানসী – হ্যাঁ বৌদি নেহা সত্যি বলছে।
সুলগ্না – আছা ঠিক আছে। স্বপনের সাথে দেখা হল না। নেহা স্বপনকে দেখে রাখবে। খুব ভাল ছেলে আর তোমাকে খুব ভালবাসে।
নিহারিকা – সে নিয়ে তুমি চিন্তা করো না।
সুলগ্না – মানসী আমার মেয়েকে দেখো।
বড়দা – বেশী কথা বল না
সুলগ্না – হ্যাঁ গো আমার খুম পাচ্ছে। একটু ঘুমাবো।
জামাইবাবু গিয়ে ডাক্তারকে ডেকে আনেন। ডাক্তার সবাইকে বাইরে যেতে বলে। ডাক্তার বাবু একটু পড়ে বেড়িয়ে এসে বলেন যে যে কাছা কাছি আছে সবাইকে ডেকে একবার সুলগ্না বৌদির সাথে দেখা করিয়ে দিতে। তখন প্রায় রাত দশ টা বাজে। মানসীর বাকি দাদা দিদিরা কাছেই ছিল। যারা ছিল সবাই গিয়ে বৌদির সাথে কথা বলে আসে। রাত্রি সাড়ে দশটায় বৌদি ঘুমিয়ে পড়ে।
সেই ঘুম আর ভাঙ্গেনি। ভোর চারটে নাগাদ ঘুমের মধ্যেই সবাইকে ছেড়ে চলে যান।
(#০৫)
সুলগ্না বৌদি চলে যাবার পর মানসী একদম ভেঙ্গে পড়ে। ও ওর বড়দাকে একদম সহ্য করতে পারে না। কোন মানুষ সে বন্ধুই হোক বা শত্রু, এইভাবে হটাত করে একদিনের মধ্যে চলে যেতে পারে এটা ও ভাবতেই পারেনি। ওর সব সময়েই মনে হতে থাকে ওর বৌদি সাথেই আছে। ও জানত ওর বৌদির মাঝে মাঝেই এইরকম জ্বর হত আর বড়দা প্যারাসিটামল খাইয়ে দিতেন। কোনদিন কোন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাননি। শুরু থেকে যদি চিকিৎসা হত তবে নিশ্চয় বৌদি এতো তাড়াতাড়ি চলে যেতেন না।
বৌদির শেষ কাজ মিটে যাবার পরেও সাড়া বাড়ি থমথম। সবাই চুপ চাপ, বেঁচে থাকতে হয় তাই বেঁচে থাকা। হতে পারে বাড়ির সবাই স্বার্থপর। হতে পারে সবাই শুধু নিজের টুকুই বুঝত, সব বিষয়েই একে অন্যের সাথে মতবিরোধ বা তর্ক করত। কিন্তু একজায়গায় সবাই এক মত ছিল। সুলগ্না সবাইকে ভালোবাসতো আর সবাই সুলগ্নাকে চাইত। সংসারে এই রকম চরিত্র বড় বিরল। কিন্তু আজকাল আমার মনে হয় স্বর্গে ভগবানের কাছে ভাল লোক কম পড়ে গেছে। তাই আমাদের মধ্যে থেকে ভাল মানুষদেরই ভগবান তাড়াতাড়ি নিজের কাছে ডেকে নেন। সবাই কোন রকমে খায়। মাছ মাংস খাওয়া ভুলেই গেছে। কোনোরকমে ডাল ভাত দিয়ে খাওয়া সারে। অফিসে বা ব্যবসায় যেতে হয় তাই যাওয়া।
তবু জীবন থেমে থাকবে না। মানসীর কাছে প্রধান দায়িত্ব আসে বৌদির মেয়ে সৃজা কে মানুষ করা। সৃজা তখন ক্লাস থ্রি তে পড়ে। ও সৃজার সব কিছু নিজের কাঁধে তুলে নেয়। সকালে উঠে আগে সৃজাকে রেডি করে, ওর টিফিন বানিয়ে, স্কুলে পাঠায়। তারপর নিজে স্কুলে যায়। সৃজা স্কুল ছুটির পরে টিচার্স রুমে বসে থাকে। মানসী স্কুল থেকে ফেরার সময় ওকে নিয়ে ফেরে। আগে সুলগ্না নিয়ে আসতো। রাত্রেও সৃজা ওর রাঙ্গাপির কাছে ঘুমায়।
প্রায় মাস খানেক পড়ে একদিন সৃজা বলে – রাঙ্গাপি আমরা আর মাছ খাব না ?
তখন সবার খেয়াল হয় ওরা নিজের দুঃখে বাচ্চা মেয়েটাকেও কষ্ট দিচ্ছে!
(#০৬)
এরমধ্যে স্বপন অনেকদিন কলকাতায় আসেনি। ও অফিসের ট্রেনিঙে এক মাসের বেশী দিল্লিতে ছিল। দিল্লি থেকে ও নিহারিকার সাথে ফোনে কথা বলেছিল, কিন্তু নিহারিকা ফোনে সুলগ্না বৌদিকে নিয়ে কিছু বলেনি। যেদিন স্বপন কলকাতা আসে আর নিহারিকার সাথে দেখা করে, সব কিছু জানতে পারে। স্বপন গলা ছেড়ে কাঁদতেও পারেনা, চোখের জলও আটকে রাখতে পারে না। নিঃশব্দে চোখের জল ফেলে। চোখ মুছে উঠে বলে মানসীদের বাড়ি যাবে। নিহারিকার মা বলেন একটু চা জল খেয়ে যেতে। কিন্তু স্বপন সেসব শোনে না। বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায়। পেছন পেছন নিহারিকাও যায়। একটা ট্যাক্সি নিয়ে মানসীদের বাড়ি পৌঁছায়।
সৃজা ওকে দেখেই এসে ওর হাত ধরে। ও তখন থেকেই স্বপন কে পিসে বলে ডাকতো। স্বপন আর নিহারিকা ঘরে ঢোকে। সুলগ্না বৌদির মালা দেওয়া ছবির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। প্রনাম করতেও পারে না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টলতে শুরু করে। মানসী গিয়ে স্বপনকে ধরে পাশে সোফাতে বসিয়ে দেয়।
সৃজা – জানো পিসে মা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে, আর আসবে না। আমি রাত্রে হাসপাতালে গিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম কিন্তু তার পরদিন আর ঘুম থেকেই উঠল না।
মানসী এসে সৃজাকে কোলে তুলে নেয় আর চুপ করতে বলে।
সৃজা – তোমরা বাড়ীতে কিছু খারাপ হলেই বা কারো কিছু হলেই পিসে কে বল আর পিসে ঠিক করে দেয়। তাই আমি আমার কথা পিসেকে বলছি। পিসে ঠিক মাকে নিয়ে আসবে।
স্বপন আর বসে থাকতে পারে না। ও সৃজা আর মানসীকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে।
প্রকৃতির কালবৈশাখী একরাত্রি থাকে আর তার ক্ষত থাকে পরের সাত দিন। জীবনের কালবৈশাখীও এক রাতের জন্যই আসে কিন্তু তার ক্ষত আর একটু বেশী সময় ব্যাথা দেয়। কিন্তু কিন্তু একসময় কালবৈশাখীর মেঘ কেটে গিয়ে সূর্য উঠে আসে।
(#০৭)
মানসীদের বাড়ীতে সেই সূর্য ওঠে নিহারিকার বিয়েতে। স্বপন আর নিহারিকার বিয়ের দিন সুলগ্নার মৃত্যুর আগেই ঠিক হয়ে গিয়েছিলো। স্বপনের বিয়ে ঠিক ছিল ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। সুলগ্না বৌদি মারা যাবার পাঁচ মাস পড়ে। স্বপন চাইছিল না বৌদি মারা যাবার এক বছর না হতেই বিয়ে করতে। কিন্তু স্বপনের ওই সিদ্ধান্তে প্রথম আপত্তি জানায় মানসী আর বড়দা।
মানসী – তোমাদের বিয়ে পিছিয়ে দেবার কোনই কারন নেই।
বড়দা – আমাদের শাস্ত্রের নিয়মে এক বছরের মধ্যে আমাদের বাড়ীতে কোন বিবাহ নিষিদ্ধ। কিন্তু তোমার বা নিহারিকার বাড়ীতে সে বাধা নিসেধ নেই।
স্বপন – সুলগ্না বৌদিকে আমি আমার নিজের বৌদি বলেই মানি।
বড়দা – সে আমি বুঝি। কিন্তু তাও আমি বলব তোমরা তোমাদের বিয়ে পিছিয়ে দিও না।
ওনারা তখনও স্বপনকে ঠিক জানত না বা পুরো বিশ্বাস করত না। ওনাদের চিন্তা ছিল স্বপন বাইরে থাকে, কোনদিন যদি অন্য কোন মেয়ে দেখে ওদের নিহারিকাকে বিয়ে করতে না চায়। তাই ওনারা চাইতেন যত তাড়াতাড়ি হোক বিয়েটা দিয়ে দেবার।
মানসী নিজেও জানত না ও কেন চাইছিল না বিয়েটা পিছিয়ে দিতে।
আর স্বপনের পক্ষেও ওর বাড়ীতে এই কারন বোঝানো খুব কঠিন ছিল। নিহারিকার বাড়ি থেকেও বিয়ে পেছোতে চাইল না। তাই ওদের বিয়ে প্ল্যান হিসাবেই হয়ে যায়। সে সময় সবাই দুঃখ ভুলে গিয়ে হাসতে শুরু করে।
বিয়ের সাত দিন আগে স্বপন আর নিহারিকা দক্ষিণেশ্বর যায়। দুজনেরই মনে পড়ে এর আগের বার সুলগ্না বৌদি সাথে ছিল। স্বপনরা পৌঁছানোর একটু পরেই মানসী আর কস্তূরী পৌঁছায়। কস্তূরীর সাথে ওর বয় ফ্রেন্ডও ছিল। ও বলতে ভুলে গেছি এর মধ্যে কস্তূরী মনের মানুষ খুঁজে পেয়ে গিয়েছিলো। স্বপন আলাপ করে ছেলেটার সাথে। বেশ ভালই লাগে। পুজা দেবার পড়ে কস্তূরীকে আলাদা পেয়ে স্বপন জিজ্ঞাসা করে।
স্বপন – কিরে এই ছেলেটা তোর কোন দিকে তাকায় ?
কস্তূরী – মানে ?
স্বপন – মানে ও তোর মুখ দেখে না বুক দেখে ?
কস্তূরী – আগে মুখ দেখে, তার পর হয়তো একটু বুকের দিকে তাকায়।
স্বপন – তুই সামনে ঝুঁকে পরলে ও কি করে ?
কস্তূরী – ও ভাবে আমি পড়ে যাচ্ছি তাই আমাকে হাত ধরে তুলে ধরে।
স্বপন – খুব ভাল, সত্যি খুব ভাল।
মানসী একসময় স্বপনকে বলে যে ওই ছেলেটা কস্তূরীর বাবার পয়সা দেখে কস্তূরীকে পছন্দ করেছে। স্বপন বলে প্রায় সব ছেলেরই একটা না একটা দিকে দুর্বলতা থাকে। এই ছেলেটার নারীর থেকে নারীর বাড়ি বেশী পছন্দ। তাতে কি আর করা যাবে। হয়তো কস্তূরীও এইরকমই চায়।
মানসী – সবাই কি আর স্বপন কে পায় !
সবাই মোটামুটি হৈচৈ করেই সময় কাটায়। স্বপন একটা জিনিস লক্ষ্য করে যে ও মানসীর হাত ধরলে বা জড়িয়ে ধরলে মানসী আর নিস্তেজ হয়ে যায় না।
স্বপন আর নিহারিকার বিয়ের পড়ে বৌভাতে সবাই মিলে স্বপনের গ্রামের বাড়ীতে যায়। কস্তূরীও গিয়েছিলো। মানসীরা যাবার আগে স্বপন আর নিহারিকার সাথে দেখা করতে যায়।
সৃজা – পিসে সবাই বলছে আজকে তুমি আমার সত্যি সত্যি পিসে হলে। তবে আগে তুমি কি ছিলে ?
স্বপন – আমি আগেও তোমার পিসে ছিলাম, আজকেও তোমার পিসেই আছি।
সৃজা – তবে বিয়ে করলে কি হল
স্বপন – আগে তোর পিসি আমার বৌ ছিল না, আজ থেকে আমার বৌ হল
সৃজা – খুব ভাল।
কে জানে সৃজা কি ভাল বুঝেছিল।
কস্তূরী – নেহা শোন আজ সব শিখে নিবি, আর কিছুদিন পরেই আমার বিয়ে। আমাকে সব বলবি।
নিহারিকা – আমি পারবো না, ওইসব বলতে। তোর স্বপন দাকে জিজ্ঞাসা করবি।
স্বপন – হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক আছে, আমি তো আছি, তোমাকে শিখিয়ে দেব।
নিহারিকা – না তোমাকে আর শেখাতে হবে না। ও নিজে নিজেই শিখে যাবে।
মানসী – কস্তূরীর দুষ্টু বুদ্ধি আর গেল না।
স্বপন – দেখো রাঙা দিদি আমি আগে নিহারিকাকে চুমু খেয়েছিলাম তার পর তোমাকে চুমু খেয়েছিলাম।
মানসী – তাতে কি হল ?
স্বপন – আজ আমি নিহারিকার সাথে যা যা করবো, কাল তোমার সাথে ঠিক তাই করবো।
নিহারিকা – আমার কোন আপত্তি নেই তাতে
মানসী – ইঃ খায় কত। তোমার সাথে ওইসব করতে আমার বয়েই গেছে।
মানসী মুখে এই কথা বললেও মনে মনে ভাবে হলে খুব একটা খারাপ হবে না।
স্বপন আর নিহারিকা বিয়ের পরে রাঁচি চলে যায়। ওদের জীবনের কথা কখনও অন্য গল্পে শোনাবো। এই কাহিনী মানসীকে নিয়ে তাই আমরা মানসীকে দেখি ও কি করছে।
তৃতীয় পরিচ্ছদ সমাপ্ত